‘সরকার' অতি পরিচিত একটি শব্দ। বিশ্বের সব দেশেই কোনো না কোনো সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকার কাকে বলে সে সম্পর্কে আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে জেনেছি। মূলত সরকারের দ্বারা একটি দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সকল দেশে সরকার থাকলেও তা একরকম নয় । এ অধ্যায়ে আমরা আমাদের দেশের সরকার-পদ্ধতি সম্পর্কে জানব ।
এ অধ্যায় পড়া শেষে আমরা-
♦ বাংলাদেশ সরকারের স্বরূপ উল্লেখ করতে পারব
♦ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি বর্ণনা করতে পারব
♦ বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো বর্ণনা করতে পারব বাংলাদেশের আইনসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি বর্ণনা করতে পারব
♦ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি বর্ণনা করতে পারব ।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠিত হয় । বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র । এই রাষ্ট্রে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রদত্ত ও তাঁর উপর অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করে থাকেন। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার উপর ন্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সরকার ব্যবস্থার মতো বাংলাদেশ সরকারের তিনটি বিভাগ আছে ।
সেগুলো হচ্ছে: (১) নির্বাহী বিভাগ (২) আইন বিভাগ ও (৩) বিচার বিভাগ
নিচে এদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে আমরা জানব ।
নির্বাহী বিভাগ: নির্বাহী বিভাগকে শাসন বিভাগও বলা হয়ে থাকে । এটি মূলত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে গঠিত ।
রাষ্ট্রপতি: রাষ্ট্রপতি হলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হন। তাঁর কার্যকাল পাঁচ বছর । রাষ্ট্রপতি পুননির্বাচিত হতে পারেন। তবে একাদিক্রমে হউক বা না হউক কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন না। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগ আনা যায় না । তবে সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর কোনো অভিযোগে জাতীয় সংসদ অভিশংসনের (অপসারণ পদ্ধতি) মাধ্যমে তাঁকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অপসারণ করতে পারে ।
রাষ্ট্রপতি হতে হলে কোনো ব্যক্তিকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক ও কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়স্ক হতে হবে । এছাড়া তাঁর জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। যদি কেউ অভিশংসন দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত হন তাহলে তিনি আর রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না ।
রাষ্ট্রপতি অনেক দায়িত্ব পালন করেন । তার ক্ষমতা ও কার্যক্রম নিম্নরূপ :
১. রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান । সরকারের সকল শাসনসংক্রান্ত কাজ তাঁর নামে পরিচালিত হয় । তিনি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করেন । অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের (মহাহিসাব রক্ষক, রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) নিয়োগের দায়িত্বও রাষ্ট্রপতির । প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত। তিন বাহিনীর (সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী) প্রধানদের তিনিই নিয়োগ দেন । প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতিত রাষ্ট্রপতি তাঁর সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করেন ।
২. রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করতে, স্থগিত রাখতে ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন । তিনি সংসদে ভাষণ দিতে ও বাণী পাঠাতে পারেন । রাষ্ট্রপতি কিছু আইন প্ৰণয়ন সংক্রান্ত কাজ করেন। সংসদ কর্তৃক গৃহীত কোনো বিলে তিনি সম্মতি দান করলে বা সম্মতি দান করেছেন বলে গন্য হলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। সংসদ ভেঙ্গে যাওয়া অবস্থায় অথবা সংসদ অধিবেশনরত অবস্থায় না থাকলে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারেন।
৩. রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কোনো অর্থ বিল সংসদে উত্থাপন করা যায় না । কোনো কারণে সংসদ কোনো ক্ষেত্রে অর্থ মঞ্জুর করতে অসমর্থ হলে রাষ্ট্রপতি ৬০ দিনের জন্য সংশ্লিষ্ট তহবিল হতে অর্থ মঞ্জুর করতে পারেন ।
৪. রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং তাঁর সাথে পরামর্শ করে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগদান করেন । তিনি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করতে পারেন ।
৫. যুদ্ধ বা অন্য দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে দেশের নিরাপত্তা বা শান্তি বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন । তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি প্রয়োজন হয় ।
৬. এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি আরও অনেক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন । দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের খেতাব, পদক ও সম্মাননা প্রদান করতে পারেন । রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়া দেশের কোনো নাগরিক অন্য কোনো দেশের দেওয়া উপাধি, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করতে পারে না। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চুক্তি, দলিল তাঁর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও বিচারপতিদের শপথবাক্য পাঠ করান ।
বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। এ ব্যবস্থায় দেশের সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যে সংসদ-সদস্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান তাঁকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। তবে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয় কিংবা সংসদ ভেঙ্গে দেবার জন্য রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে পরামর্শ দান করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তাঁর মন্ত্রিসভাও ভেঙে যায় । তাই প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের স্তম্ভ বলা হয়। তিনি একইসাথে সংসদের নেতা ও সরকারপ্রধান ।
দীনেশ গুনাবর্ধনে
মাহিন্দা রাজাপাকসে
জয় প্রেমাদাসা
শ্রীকান্ত বিজয়সেনা
প্রধানমন্ত্রীকে বহুবিধ কাজ সম্পাদন করতে হয় । যেমন -
১. সংবিধান অনুযায়ী দেশের সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শাসন কার্য পরিচালনা করেন । মন্ত্রিপরিষদের সহযোগিতায় তিনি শাসনসংক্রান্ত সকল দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার সদস্য, সাংবিধানিক পদে রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিদেশে রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি নিয়োগ দেন ।
২. প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের প্রধান । তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা নির্ধারণ করেন ও মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করেন । মন্ত্রীদের কাজ তদারক করেন । বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় করেন । সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্ত্রীগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও অনুমোদন নিয়ে কাজ করেন । তিনি যেকোনো মন্ত্রীকে তার পদ থেকে অপসারণের পরামর্শ দিতে পারেন ।
৩. প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের একজন সদস্য ও সংসদ নেতা । তিনি সংসদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । যেমন- সংসদ অধিবেশনে নির্ধারিত দিনে সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব প্রদান করেন, সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী ও কার্যক্রম তুলে ধরে সংসদে বক্তৃতা প্রদান করেন। এছাড়া তিনি জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত বা ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন ।
8. সংসদে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে কোনো সরকারি বিল উত্থাপনের পূর্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। যদি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদ উক্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন তবেই তা সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করা যায় । এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও পরামর্শে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের (জাতীয়) বাজেট প্রণয়ন ও সংসদে উপস্থাপন করেন । এভাবে তিনি আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকেন ।
৫. পররাষ্ট্র বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন । প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না । আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন ।
৬. দেশের জরুরি অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া যেকোনো নির্দেশ দিতে পারেন ।
৭. প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্বার্থের রক্ষক । জাতীয় স্বার্থে তিনি বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা ও বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেন ও জনগণের মধ্যে সংহতি রক্ষায় কাজ করেন ।
সরকার পরিচালনার জন্য দেশে একটি মন্ত্রিপরিষদ আছে । প্রধানমন্ত্রী এর নেতা । তিনি যেরূপ সংখ্যক প্রয়োজন মনে করেন, সেরূপ সংখ্যক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন । মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রীগণ সাধারণত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হন । সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য কিন্তু সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিও মন্ত্রী নিযুক্ত হতে পারেন । তবে তার সংখ্যা মন্ত্রিপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যার এক-দশমাংশের বেশি হবে না । প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করেন। মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে মন্ত্রিসভাও ভেঙে যায় । প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাজের সুবিধার্থে মন্ত্রিসভার যেকোনো মন্ত্রীর দপ্তর পরিবর্তন কিংবা অপসারণ করতে পারেন । আবার যে কোনো মন্ত্রী ইচ্ছে করলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে পারেন।
মন্ত্রীপরিষদ দেশের শাসনসংক্রান্ত সব কাজ পরিচালনা করার ক্ষমতার অধিকারী । দেশের শাসন ব্যবস্থার চারদিকে রয়েছে এর নিয়ন্ত্রণ । এখন আমরা এর ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে জানব ।
১. মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর কাজে সহায়তা করেন। মন্ত্রীগণ নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন । মন্ত্রিসভার ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের নিকট জবাবদিহি করতে হয় ।
২. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের নিয়মিত সভা অনুষ্ঠিত হয় । এ সভায় দেশের শাসনসংক্রান্ত সকল বিষয় (যেমন আইন-শৃংখলা রক্ষা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বৈদেশিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, দ্রব্যমূল্য ও খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি) আলোচিত হয় এবং এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।
৩. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় করে থাকে ।
৪. আইন প্রণয়ন বা পুরাতন আইন সংশোধনের উদ্দেশ্যে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ নিজ নিজ বিভাগ/ মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী আইনের খসড়া তৈরি করে অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে বিল আকারে উপস্থাপন করেন ।
৫. প্রতিবছর সরকার দেশ পরিচালনার জন্য বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করে । অর্থমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে খসড়া বাজেট প্রণীত হয় । মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন । খসড়া বাজেট সংসদে উপস্থাপন করে অনুমোদন করানো মন্ত্রিপরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
৬. দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিভিন্ন বাহিনী গঠন ও পরিচালনায় মন্ত্রিপরিষদ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। যেমন- দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বয়ের জন্য রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আবার দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য গঠিত বিভিন্ন বাহিনীসমূহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে ।
৭. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে । বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি সম্পাদন, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদের। জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা ঠিক রেখে মন্ত্রিপরিষদ এসব কাজ করে ।
৮. মন্ত্রিপরিষদ সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। সরকারের নীতি জনগণের কাছে তুলে ধরে এবং ঐসব নীতির পিছনে জনগণের সমর্থন আদায় করে ।
রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব প্রশাসনের । রাষ্ট্রের ভিতরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুষ্ঠু প্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই। প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো স্তরভিত্তিক। এর দুটি প্রধান স্তর আছে । প্রথম স্তরটি হলো কেন্দ্রীয় প্রশাসন (সচিবালয়)। দেশের সব ধরনের প্রশাসনিক নীতি ও সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়। আর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্ত মাঠ প্রশাসনের মাধ্যমে সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দ্বিতীয় স্তরটি হলো মাঠ প্রশাসন। মাঠ প্রশাসনের প্রথম ধাপ হলো বিভাগীয় প্রশাসন। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলার পর আছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। মাঠ প্রশাসন মূলত কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় ৷
কয়েকটি মন্ত্রণালয় নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসন বা সচিবালয় গঠিত। প্রতি মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত আছে বিভিন্ন বিভাগ বা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের/দপ্তরের প্রধান হলেন মহাপরিচালক/পরিচালক। মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও আছে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বোর্ড ও কর্পোরেশন । এসব দপ্তর ও অফিসের কোনো কোনোটির কার্যকলাপ আবার বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। দপ্তর/অধিদপ্তরগুলো সচিবালয়ের লাইন সংস্থা হিসেবে বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করে ।
মন্ত্রণালয় হলো প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। আর যে স্থানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলো অবস্থিত তা সচিবালয় নামে পরিচিত। প্রতিটি মন্ত্রণালয় একজন মন্ত্রীর অধীনে ন্যস্ত। মন্ত্রীর প্রধান কাজ প্রকল্প প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন সচিব। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রিকে নীতি নির্ধারণে পরামর্শ প্রদান করেন ৷ মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নের দায়িত্ব সচিবের উপর ন্যস্ত।
অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি সচিবকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে সহায়তা করেন । কোনো মন্ত্রণালয়ে সচিব না থাকলে তিনি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন । মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি অণুবিভাগের জন্য একজন করে যুগ্ম সচিব থাকেন। তিনি সচিবকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন । মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী এবং অফিস ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রণালয়ের এক বা একাধিক শাখার দায়িত্বে থাকেন একজন উপসচিব । তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নীতি নির্ধারণে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে পরামর্শ দেন ও সহযোগিতা করেন ।
প্রতি শাখায় একজন সিনিয়র সহকারী সচিব ও একজন সহকারী সচিব রয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উপসচিবের সাথে পরামর্শ করে তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন । মন্ত্রণালয়ে আরও বিভিন্ন ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন । তাঁরাও মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কার্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।
উল্লেখ্য, সরকারের কয়টি মন্ত্রণালয় থাকবে এবং একটি মন্ত্রণালয়ে কতজন অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব থাকবেন তার নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই । সরকার ও মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি অনুযায়ী তাদের সংখ্যা নির্ধারিত হয়ে থাকে ।
বাংলাদেশে আটটি বিভাগ আছে। প্রতিটি বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান হলেন একজন বিভাগীয় কমিশনার কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিভাগের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন । তিনি তাঁর কাজের জন্য কেন্দ্রের নিকট দায়ী থাকেন। বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসকদের কাজ তদারক করেন । বিভাগের উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধান করেন । ভূমি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন ও খাস জমির তদারক করেন । বিভাগের ক্রীড়া উন্নয়ন, শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে কাজ করেন । জনকল্যাণ ও সেবামূলক কাজ পরিচালনা করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন ।
জেলা প্রশাসন মাঠ বা স্থানীয় প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর । এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন জেলা প্রশাসক । দেশের সব জেলায় একজন করে জেলা প্রশাসক আছেন । তাঁকে কেন্দ্র করে জেলার সকল সরকারি কাজ পরিচালিত হয়। নিচে তার কাজগুলো সম্পর্কে জানব ।
১. প্রশাসনিক কাজ : জেলা প্রশাসক কেন্দ্র থেকে আসা সকল আদেশ-নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। জেলার বিভিন্ন অফিসের কাজ তদারক ও সমন্বয় করেন। জেলার বিভিন্ন শূন্য পদে লোক নিয়োগ করেন ৷
২. রাজস্ব সংক্রান্ত ও আর্থিক কাজ : জেলা প্রশাসক জেলা কোষাগারের রক্ষক ও পরিচালক । জেলার সব ধরনের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তার, সে কারণে তিনি কালেকটর নামে পরিচিত। এ ছাড়া তিনি ভূমি উন্নয়ন, রেজিস্ট্রেশন ও রাজস্বসংক্রান্ত বিবাদ মীমাংসা করে থাকেন ।
৩. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত কাজ : জেলার মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত । তিনি পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যে এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন ।
8. উন্নয়নমূলক কাজ : জেলা প্রশাসক জেলার সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ (শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, রাস্তাঘাট ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি) বাস্তবায়নের দায়িত্বও তাঁর । তিনি জেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন ।
৫. স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত কাজ : জেলা প্রশাসক স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর (উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন) কাজ তত্ত্বাবধান করেন । তিনি জেলার অধীনস্থ সকল বিভাগ ও সংস্থার কাজের সমন্বয় করেন।
জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে তিনি আরও অনেক দায়িত্ব পালন করেন । তিনি জেলার সংবাদপত্র ও প্রকাশনার জন্য নিবন্ধন প্রদান, আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ের লাইসেন্স প্রদান এবং জেলার বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সে সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশে মোট ৪৯২টি প্রশাসনিক উপজেলা আছে। উপজেলার প্রধান প্রশাসক হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। উপজেলার প্রশাসনিক কাজ তদারক করা তাঁর অন্যতম দায়িত্ব । এছাড়া তিনি উপজেলার সকল উন্নয়নকাজ তদারক করেন ও সরকারি অর্থের ব্যয় তত্ত্বাবধান করেন । তিনি উপজেলা উন্নয়ন কমিটির প্রধান। বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন । উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা কোষাগারের রক্ষক । বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্যান্য দায়িত্বও তিনি সম্পাদন করেন ।
বাংলাদেশের আইনসভা:
গঠন
সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইনসভা অন্যতম । বাংলাদেশের আইনসভার নাম জাতীয় সংসদ। এটি এক কক্ষবিশিষ্ট । জাতীয় সংসদের মোট সদস্যসংখ্যা ৩৫০। এর মধ্যে ৩০০ জন সদস্য জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং অবশিষ্ট ৫০টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত । বাংলাদেশকে মোট ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এ সকল নির্বাচনী এলাকা থেকে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন করে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যার আনুপাতিক হারে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যরা সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তবে মহিলা সদস্যগণ ইচ্ছা করলে ৩০০ আসনের যে কোনোটিতে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতার মাধ্যমেও নির্বাচিত হতে পারেন।
সংসদে একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার থাকেন। তাঁরা সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তাঁদের কাজ সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করা। সংসদের কার্যকাল পাঁচ বছর। এর পূর্বেও রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। সংসদের একটি অধিবেশন সম্পন্ন হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে আরেকটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে হয়। মোট সদস্য সংখ্যার মধ্যে কমপক্ষে ৬০ জন উপস্থিত থাকলে কোরাম হয় এবং সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করা যায় । প্রধানমন্ত্রী সাধারণত সংসদের নেতা । আসনসংখ্যার দিক দিয়ে নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী দলের প্রধান সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়। সংসদের অনুমতি ছাড়া একনাগাড়ে ৯০ বৈঠক দিবস সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায় ।
পাঁচ বছর পর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । ন্যূনতম ২৫ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন । তবে কেউ আদালত দ্বারা দেউলিয়া বা অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হলে বা অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে বা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ড ভোগ করলে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন ।
জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি নিম্নরূপ :
১. বাংলাদেশের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ন্যস্ত। সংসদ যেকোনো নতুন আইন প্রণয়ন, পৌরনীতি ও নাগরিকতা প্রচলিত আইনের পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারে । কোনো নতুন আইন পাস করতে হলে খসড়া বিলের আকারে তা সংসদে পেশ করা হয়। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে বিলটি গৃহীত হওয়ার পর এবং বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রতির সম্মতি লাভের পর তা আইনে পরিণত হয় ।
২. জাতীয় সংসদ নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম তদারকি করে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণ সংসদের নিকট দায়ী থাকেন। কোনো কারণে সংসদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা আনলে মন্ত্রিসভা ভেঙে যায় । মুলতুবি প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব, অনাস্থা প্রস্তাব, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, সংসদীয় বিভিন্ন কমিটি ও সংসদে সাধারণ আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় সংসদ শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সদস্যগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন ।
৩. জাতীয় সংসদের অনুমতি ছাড়া কোনো কর বা খাজনা আরোপ ও আদায় করা যায় না । সংসদ প্রতিবছর জাতীয় বাজেট পাস করে। অর্থমন্ত্রী বাজেটের খসড়া সংসদে উপস্থাপন করেন । সংসদ সদস্যগণ দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ তা পাস করেন ।
৪. জাতীয় সংসদের বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে । কোনো সংসদ সদস্য অসংসদীয় আচরণ করলে স্পিকার তাঁকে বহিষ্কার করতে পারেন । তাছাড়া সংবিধান লঙ্ঘন করলে সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে ।
৫. সংসদ সংবিধানে উল্লিখিত নিয়মের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করতে পারে । তবে এজন্য সংসদের মোট সদস্যের কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের দরকার হয়।
৬. জাতীয় সংসদের সদস্যগণ সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত করেন । সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যগণও সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন । এ ছাড়া সংসদ সদস্যগণ দেশের রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করে থাকেন ।
বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার রয়েছে । এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় সংসদ সকল জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু । সংসদকে অর্থবহ ও কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন সৎ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন সংসদ সদস্য। সংসদে আরও প্রয়োজন দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী বিরোধী দল । সৎ ও যোগ্য প্রার্থীগণ যাতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে ।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ:
বাংলাদেশ সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম । নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, অপরাধীর শাস্তিবিধান এবং দুর্বলকে সবলের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম । বিচার বিভাগ আইনের অনুশাসন ও দেশের সংবিধানকে অক্ষুণ্ণ রাখে ।
বিচার বিভাগের গঠন:
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে গঠিত ।
সুপ্রিম কোর্ট:
বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আদালতের নাম সুপ্রিম কোর্ট। এর রয়েছে দুটি বিভাগ, যথা : আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ । সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, যাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বলা হয় । রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিযুক্ত করেন। প্রত্যেক বিভাগের জন্য যতজন বিচারক প্রয়োজন ততজন বিচারককে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত । প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগ দেন । প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন । সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে হলে তাকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে । সুপ্রিম কোর্টে কমপক্ষে ১০ বছর এডভোকেট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা বাংলাদেশে বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছর বিচারক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ ৬৭ বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে কর্মরত থাকতে পারেন ।
সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি:
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের পৃথক কার্যের এখতিয়ার আছে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
আপিল বিভাগের ক্ষমতা ও কাজ:
♦ আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়, ডিক্রি বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল গ্রহণ করে শুনানির ব্যবস্থা করতে পারে ।
♦ রাষ্ট্রপতি আইনের কোনো ব্যাখ্যা চাইলে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে থাকে ।
♦ ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোনো ব্যক্তিকে আদালতের সামনে হাজির হতে ও দলিলপত্র পেশ করার আদেশ জারি করতে পারে ।
♦ আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য অবশ্যই পালনীয় ।
এভাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা, ন্যায়বিচার সংরক্ষণ ও পরামর্শ দান করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতা ও কাজ:
♦ নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে ।
♦ কোনো ব্যক্তিকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারে অথবা এ ধরনের কোনো কাজ করাকে বেআইনি ঘোষণা করতে পারে।
♦ অধস্তন কোনো আদালতের মামলায় সংবিধানের ব্যাখ্যাজনিত জটিলতা দেখা দিলে উক্ত মামলা হাইকোর্টে স্থানান্তর করে মীমাংসা করতে পারে ।
♦ অধস্তন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল গ্রহণ করে ।
♦ সকল অধস্তন আদালতের কার্যবিধি প্রণয়ন ও পরিচালনা করে ।
আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ মিলে সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে দেশের সংবিধান ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে ।
অধস্তন আদালত : সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় বিচার বিভাগের অধস্তন আদালত আছে। অধস্তন আদালতগুলো ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করে ।
জেলা ও দায়রা জজ আদালত : স্থানীয় পর্যায়ে দেওয়ানি (জমিজমাসংক্রান্ত, ঋণচুক্তি ইত্যাদি) ও ফৌজদারি (সংঘাত, সংঘর্ষ সংক্রান্ত) বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধিনে জেলা ও দায়রা জজ রয়েছে। এ আদালতের প্রধান হলেন জেলা জজ। অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জজ ও সহকারী জজ আলাদা আলাদাভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। এ সকল আদালতের রায় নিয়ে জেলা জজের কাছে আপিল করা হয়। তবে আপিল ছাড়াও জেলা জজ মৌলিক মামলা পরিচালনা করে থাকেন।
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল : সংবিধান অনুযায়ী সংসদ আইন দ্বারা এক বা একাধিক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে পারে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত কোন বিষয়ে অন্য কোন আদালতে বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হয় না।
আরও দেখুন...